শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর লুটপাটের শিকার হয় দেশের ঐতিহ্যবাহী ক্লাব আবাহনী লিমিটেড। ক্লাবের অস্থায়ী ভবনের ৮টি কক্ষের প্রতিটিতে ভাংচুর চালানো হয়। নগদ অর্থের পাশাপাশি লুট করা হয় ক্লাবের ৫২ বছরের অর্জনের সব স্মারক ট্রফি। মঙ্গলবার ক্ষয়ক্ষতি দেখতে বিকালে বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের আবাহনীর সাবেক খেলোয়াড় ও কয়েকজন সাবেক-বর্তমান পরিচালক এসেছিলেন ক্লাব প্রাঙ্গণে। তারা আকুতি জানালেন দেশের অন্যতম সেরা এই ক্লাবটির ট্রফি ও গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ফেরত দেওয়ার।
গত ৫ আগস্ট বিকাল ৫টার পর প্রায় তিনশ-চারশ অজ্ঞাত বিক্ষোভকারী এসে চড়াও হয় আবাহনীর অস্থায়ী অফিসে। মূল ফটক বরাবর থাকা আবাহনী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামালের প্রতিকৃতিতে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। এতে অর্ধেকের বেশি পুড়ে গেছে প্রতিকৃতি। এছাড়া অফিস ভবনে ঢুকে প্রতিটি কক্ষের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, বৈদ্যুতিক বাতি, ফ্যান, ল্যাপটপ, কম্পিউটার- সব কিছুই লুট করে নিয়ে যায় তারা। অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র তছনছ করার পাশাপাশি সবগুলো ট্রফি লুট করে নিয়ে যায়। যদিও পরবর্তীতে বেশ কিছু ট্রফি ফেরতে পেয়েছে ক্লাব কর্তৃপক্ষ।
ধানমন্ডির ক্লাব প্রাঙ্গণে ঘটা ধ্বংসলীলার পর গত রবিবার বেশ কয়েকজন পরিচালক এবং সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়রা ক্লাব পরিদর্শনে এসেছিলেন। দুই দিন পর আজও অনেক সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড় এসেছেন ক্লাব প্রাঙ্গণে। তাদের মধ্যে ছিলেন বর্ষীয়ান ক্রীড়া সংগঠক আবদুস সাদেক, দেওয়ান শরিফুল আরেফিন টুটুল, আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি ও তারকা ফুটবলার আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু, আব্দুল গাফফার, শেখ মোহাম্মদ আসলাম, খুরশিদ আলম বাবুল, গোলাম গাউস, ইকবাল হোসেন, জাকির হোসেন, সত্যজিত দাস রুপু ও বিপ্লব ভট্টাচার্য। এছাড়া সাবেক ক্রিকেটারদের মধ্যে খালেদ মাহমুদ সুজন, গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, দিপু রায় চৌধুরী, ইমরান হামিদ পার্থ, জাহিদ হোসেন শোভন উপস্থিত ছিলেন। এর বাইরে আবাহনী সমর্থকগোষ্ঠীর অনেকেই ছিলেন আজকের পরিদর্শনে।
সবার হৃদয়েই চলেছে রক্তক্ষরণ। সাবেক খেলোয়াড়রা ট্রফিগুলো হারিয়ে বিমর্ষ, বিধ্বস্ত। সবাই ট্রফিগুলোর জন্য হাহাকার করেছেন। প্রত্যেকে অনুরোধ রেখেছেন ট্রফিগুলো ফেরত দেওয়ার। সাবেক হকি খেলোয়াড় ও বর্ষীয়ান ক্রীড়া সংগঠক আবদুস সাদেক তার বক্তব্যে বলেছেন, ‘বিগত ৫০ বছরে আবাহনী দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্লাব। এই সময়ে আমরা যে ট্রফি অর্জন করেছি তার সংখ্যা কত আমি নিজেও জানি না। আমার যতদূর মনে পড়ে ১৯৭৪ সালে বোধ হয় আমরা ক্রিকেট, ফুটবল ও হকি তিনটি খেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। এরপর তো আমরা শত শত ট্রফি অর্জন করেছি। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় কয়দিন আগে, ক্লাব থেকে শত শত ট্রফি কে বা কারা নিয়ে গেছে। আমি আপনাদের মাধ্যমে তাদের কাছে অনুরোধ করতে চাই, আপনারা ট্রফিগুলো ক্লাব প্রাঙ্গণে ফিরিয়ে দিয়ে যান।’
জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার ও জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব আব্দুল গাফফার স্পষ্ট করে বলেছেন, ট্রফি ফেরত দিতে এসে কেউ কোনও ধরনের সমস্যায় পড়বেন না। তরুণ প্রজন্মকে আবাহনীর ইতিহাস জানানোর জন্য ট্রফিগুলোর প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘নিয়ে যাওয়া কিছু ট্রফি এর মধ্যে আমরা পেয়েছি। আমাদের অনেকের বয়সই এখন ষাটের বেশি। আমরা চলে যাবো কিন্তু নতুন প্রজন্মের কেউই আবাহনীর ঐতিহ্যগুলো দেখতে পারবে না। তরুণদের কথা চিন্তা করে হলেও ট্রফিগুলো ফেরত দিয়ে যাবেন। তরুণ প্রজন্মকে আমাদের অর্জনগুলো দেখাতে না পারলে আপনারাই দুঃখ পাবেন, কষ্ট পাবেন। আমি আশা করবো, আপনারা ট্রফিগুলো দিয়ে যাবেন, এখানে আপনাদের সঙ্গে খারাপ কিছু হবে না।’
কাজী ইনাম আহমেদ ট্রফিগুলো ফেরানোর ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানান
আবাহনীর সাবেক ক্রিকেটার ও বর্তমান বিসিবির প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু মহামূল্যবান ট্রফিগুলো ফেরতের অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, ‘এখানে অগ্রজ ও অনুজ অনেক খেলোয়াড় আছেন, অনেক সংগঠক আছেন। আমি যখন খবরটা পেলাম, আমাদের ক্লাব ভাঙচুর করা হয়েছে, সবচেয়ে মহামূল্যবান ট্রফিগুলো নিয়ে গেছে। এটা শুনে মর্মাহত হয়েছি। আমার বয়স যখন ২০ বছর, ১৯৮০ সালে আমি আবাহনীতে খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে আসি। বহু স্মৃতি জড়িয়ে এখানে, খেলোয়াড় হিসেবে খেলেছি, সংগঠক হিসেবে ছিলাম। আমি খুবই মর্মাহত, কোনও দুষ্কৃতিকারী ছাড়া এই ধরনের অপচেষ্টা কারও দ্বারা সম্ভব নয়। অন্য সবার মতো আমারও একই আকুতি থাকবে, যারা এগুলো নিয়ে গেছেন, তারা যদি কোনও মাধ্যমে কিংবা নিজেরা এসে ট্রফিগুলো ফেরত যান, খুশি হবো। এই বয়সে এসে আপনাদের কাছে আমার এই চাওয়া। আমাদের কোনও ক্ষোভ নেই আপনাদের ওপর।’
আবাহনী ও বিসিবির পরিচালক কাজী ইনাম আহমেদ মনে করেন তরুণরাই ক্লাবটির শক্তি। আবাহনীকে এগিয়ে যেতে তরুণরাই ভূমিকা রেখেছেন। আবাহনীর এতিহ্যবাহী ট্রফিগুলো ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে তিনি সরকার ও প্রশাসনকে অনুরোধ করেছেন, ‘আমাদের মাঝে সাবেক আবাহনীর সকল খেলোয়াড়, অনেক কর্মকর্তা এবং আমাদের অনেক সমর্থকগোষ্ঠী উপস্থিত আছেন। আবাহনী একটি ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে আমাদের ক্লাবটিতে যে আক্রমণ হয়েছে, আমরা সকলে মনে অনেক ব্যাথা পেয়েছি। আমাদের এই ক্লাবের অনেক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে আমাদের যে অর্জন, এত বছরের ট্রফিগুলো নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই ক্লাবটি আমাদের, বাংলাদেশের ক্লাব। আমাদের সকল ফ্যানদের ক্লাব। এটি এই ধানমন্ডির ক্লাব। আমি অনুরোধ করবো আমাদের প্রশাসনকে এবং আমাদের সরকারকে, আপনারা অবশ্যই আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখবেন। গত সপ্তাহে আমরা দেখেছি, শুধু আবাহনী ক্লাব নয়, দুর্ভাগ্যবশত আরও দুই-একটা ক্লাবে এধরনের আক্রমণ হয়েছে। আমরা জানি, আমাদের বাংলাদেশের তরুণরাই খেলাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তরুণরাই কিন্তু আবাহনীর বড় সাপোর্টার। দুর্ভাগ্যবশত এখানে কিছু দুর্বত্তরা ট্রফিগুলো লুট করে নিয়েছে। আমরা অনুরোধ করবো ট্রফিগুলো আপনারা ফেরত দিয়ে যান।’