1. admin@bartomankagoj.com : admin :
রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০১:০০ পূর্বাহ্ন

ব্যাংকে ব্যাংকে অস্ত্রের মহড়া, হারাচ্ছে নিয়ন্ত্রণ

বর্তমান কাগজ ডেস্ক :
  • প্রকাশের সময় : সোমবার, ১২ আগস্ট, ২০২৪
  • ৭৭ বার পঠিত

সরকার পতনের পর থেকেই ব্যাংকগুলোতে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুরু করে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে ‘আর্থিক দুর্নীতি ও অর্থপাচারে জড়িতদের’ এবং দখলদারদের বিতাড়িত করতে কর্মচারীদের বিক্ষোভ চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে অতীতে বিভিন্ন সময়ে বিতাড়িতরা আবার ফিরে আসার জন্য বল প্রয়োগের পাশাপাশি সন্ত্রাসের পথেও হাঁটছেন। এমনকি অস্ত্রের মহড়াও চলছে ব্যাংকে ব্যাংকে।

রবিবার (১১ আগস্ট) একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসলামী ব্যাংকে প্রবেশ করতে গিয়ে বাধার মুখে এলোপাতাড়ি গুলি করে। এতে গুলিবিদ্ধ হন ছয় জন, যাদের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। পরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিরোধের মুখে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়।

শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগ আমলে নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর হাত থেকে বেদখল হওয়া ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেছে। গত তিন দিনে বেশ কিছু ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা পদত্যাগ করে ব্যাংক ছেড়ে গেছেন।

বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা এসআইবিএল (সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি)-এর নিয়ন্ত্রণ নেন আগের উদ্যোক্তা পরিচালকেরা। এছাড়া একই গ্রুপের অধীনে কয়েক মাস আগে নিয়ন্ত্রণে যাওয়া ন্যাশনাল ব্যাংকে আবার মালিকানা বদলের তোড়জোড় চলছে। বর্তমানে ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা পলাতক আছেন। সব মিলিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ ব্যাংক ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ বন্ধ রেখেছে।

ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৭ সালে নিয়ন্ত্রণ হারানো বেসরকারি খাতের এসআইবিএল-এ গত বৃহস্পতিবার দলবল নিয়ে যান সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব.) ডা. রেজাউল হকসহ কয়েকজন পরিচালক। তারা দুই ডিএমডিকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। আর এদিন এমডি উপস্থিত ছিলেন না।

এছাড়া ২০১৭ সালে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের পরিবার ইউসিবির পর্ষদ থেকে পারটেক্স গ্রুপের সবাইকে সরিয়ে কর্তৃত্ব নেয়। সরকার পতনের পর বর্তমান পরিচালকদের আর ব্যাংকে ঢুকতে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শেয়ারহোল্ডার ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

এছাড়া নামে-বেনামে ঋণ দিয়ে তা পাচারে সহায়তাকারীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা, অবৈধ নিয়োগ বাতিল, জোর করে চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহালসহ বিভিন্ন দাবিতে কিছু সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে সম্প্রতি বিক্ষোভ হয়েছে।

অস্ত্রের মহড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকে

ইসলামী ব্যাংকে গোলাগুলির আগে অস্ত্রের মহড়া প্রথম শুরু হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। অতি সংবেদনশীল এই স্থাপনায় গত বৃহস্পতিবার অস্ত্রসহ প্রবেশ করে ১৫/২০ জন বহিরাগত। এসময় কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ নামে এক যুবকের কাছ থেকে সেনাবাহিনীর সহায়তায় আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ঘটনার আগের দিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই ডেপুটি গভর্নর, নীতি উপদেষ্টা ও আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বিএফআইইউ প্রধানকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বের করে দেয় বিক্ষোভকারীরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মো. শামিমুর রহমান বলেছেন, অস্ত্রসহ আটক যুবক বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের কাছে প্রায় প্রতিদিনই আসতো। থানা সচল না থাকায় অস্ত্র জব্দ করে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

অস্ত্রসহ বহিরাগতদের প্রবেশ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মাঝে উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। তাদের ধারণা, মাসুদ বিশ্বাসকে অসম্মানজনকভাবে বের করে দেওয়ার প্রতিশোধ নিতেই ওই যুবক দলবল নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আসে।

ইসলামী ব্যাংকে গোলাগুলি

এই ঘটনার রেশ না কাটতেই রবিবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে ইসলামী ব্যাংকে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে ছয় কর্মকর্তা-কর্মচারী গুলিবিদ্ধ হন। এদের মধ্যে শফিউল্লাহ সরদার, আবদুল্লাহ আল মামুন, আব্দুর রহমান ও বাকিবিল্লাহ ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বাকি দুজনের পরিচয় জানা যায়নি।

ইসলামী ব্যাংকে হামলার আগে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা এস আলম গ্রুপের হাতে দখলকৃত আরেক ব্যাংক এসআইবিএল-এর প্রধান কার্যালয়ের সামনে মহড়া দিয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংকটির তিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সকাল ১০টার আগে থেকেই মতিঝিলে অবস্থিত সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সামনে মহড়া দেয় একদল অস্ত্রধারী লোক। এতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এর কিছুক্ষণের মাঝেই তার শুনতে পান ইসলামী ব্যাংকে হামলার ঘটনা। এতে তারা আতঙ্কে সময় পার করছেন।

রবিবার মতিঝিলে ইসলামী ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিক্ষোভের সময় গুলির ঘটনা ঘটে
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এসআইবিএলের সামনে যারা মহড়া দিয়েছিল তারাই ইসলামী ব্যাংকে গিয়ে হামলা করেছে।

প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পরদিন এস আলম গ্রুপের নিয়োগ করা কর্মকর্তাদের ব্যাংক থেকে বের করে দেন বিক্ষুব্ধ ব্যাংকাররা। এরপর গত ৭ ও ৮ আগস্ট ব্যাংকারদের বিক্ষোভ করতে দেখা যায়।

ইসলামী ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা অবস্থায় বিপুল অঙ্কের ঋণ কেলেঙ্কারির প্রতিবাদ জানাতে রবিবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে তারা ইসলামী ব্যাংক টাওয়ারের সামনে বিক্ষোভ করছিলেন। এ সময় এস আলম গ্রুপের হয়ে কাজ করা কয়েকজন কর্মকর্তা শতাধিক লোক নিয়ে অস্ত্রসহ কার্যালয়ে প্রবেশের চেষ্টা করেন। পরে সেখানে সংঘর্ষ বেধে যায় এবং এলোপাতাড়ি গুলি চালানো হয়।

এ প্রসঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের একজন এসএভিপি বলেন, এস আলমের নিয়োগপ্রাপ্ত ডিএমডি মিফতাহ পিস্তল দিয়ে গুলি করেছে। এতে আমাদের ৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

ইসলামী ব্যাংকের এসএভিপি ড. শওকত আলী বলেন, আমরা জানতে পেরেছিলাম এস আলমের নিয়োগকৃত কর্মকর্তারা আজ ব্যাংক দখলের চেষ্টা করবে। সেজন্য আমরা সকাল থেকেই ব্যাংকের সামনে অবস্থান করছিলাম। পরে এস আলমের নিয়োগকৃত কর্মকর্তা ও বহিরাগতরা সিটি সেন্টারের সামনে থেকে এসে আমাদের কর্মকর্তাদের ওপরে সশস্ত্র হামলা চালায়। এতে আমাদের ৬ জন ভাই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দাবি করে বলেন, এস আলম গ্রুপের লোকজন পূর্বপরিকল্পিতভাবে তাদের ওপর হামলা ও গুলি চালায়। অবিলম্বে ব্যাংকের অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিচার চেয়েছেন ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

ইসলামী ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিক্ষোভ
কর্মকর্তারা ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের মাধ্যমে ‘লুটেরাদের’ বের করে দেওয়ার দাবি জানান। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুল মাওলা, অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর কাউসার আলী, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর আকিজ উদ্দিন, মিফতাহ উদ্দিনসহ এস আলম গ্রুপের নিয়োগ করা কর্মকর্তাদের ব্যাংক থেকে বের করে দেওয়ার দাবি জানান তারা।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের জুন থেকে বাজার থেকে শেয়ার কিনে ব্যাংকটির মালিকানায় চলে আসে এস আলম গ্রুপ। ব্যাংকটির প্রায় অধিকাংশ শেয়ার কিনে নেয় তারা। এরপর দেশি-বিদেশি অনেক কোম্পানি ও ব্যক্তি শেয়ার ছেড়ে দিতে শুরু করে। ওই সময়ের পর থেকে নিয়োগপ্রাপ্তদের ‘অবৈধ’ বলে এখন দাবি করছেন অন্য কর্মকর্তারা। ইসলামী ব্যাংক ছাড়াও বেসরকারি খাতের আইএফআইসি, বাংলাদেশ কমার্সসহ কয়েকটি ব্যাংকে বিক্ষোভ হয়েছে।

অন্যদিকে সুযোগ-সুবিধা ও ইনসেনটিভের দাবিতে বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকে বিক্ষোভ হয়। পদোন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা বিক্ষোভ করেন।

উত্তাল অন্যান্য ব্যাংক

আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও তার ছেলেসহ বেক্সিমকোর সব পরিচালকের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন ব্যাংকটির বর্তমান কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সময়ে চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পাশাপাশি সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ এ সরোয়ারের সময়ে যাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে তাদের পুনর্বহালের দাবি জানানো হয় বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে। রবিবার রাজধানীর পল্টনে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় প্রায় ২০০ শতাধিক ব্যক্তি এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেন।

এদিকে এনআরবিসি ব্যাংককে দুর্নীতিবাজদের কবল থেকে দখলমুক্ত রাখতে অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছে চিঠি দিয়েছে ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীরা। চিঠিতে বলা হয়, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর ১৬ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আওয়ামী লীগের পুরাতন দোসররা ভোল পাল্টে আবার এনআরবিসি ব্যাংক দখল করার পাঁয়তারা করছে। রাজনৈতিক হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ এবং ম্যানেজমেন্ট কর্তৃপক্ষ ব্যাংকটিতে ধ্বংসস্তূপ থেকে শীর্ষে নিয়ে গিয়েছেন। সেই ব্যাংকটিকে আবার দখলের পাঁয়তারা করছেন পুরাতন দুর্নীতিবাজরা।

এছাড়া বেসরকারি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংককে (এসআইবিএল) এস আলম গ্রুপের হাত থেকে মুক্ত করতে মানববন্ধন করেছে ব্যাংকটির কিছু শেয়ারধারী। রবিবার (১১ আগস্ট) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে তারা অভিযোগ করেন, এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম ও তার সহযোগীরা আমানতকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা নামে-বেনামে তুলে পাচার করেছেন। ফলে শুধু এসআইবিএল নয়, পুরো আর্থিক খাতই হুমকির মুখে পড়েছে। সাধারণ আমানতকারীরা জমাকৃত অর্থ প্রয়োজন অনুযায়ী তুলতে পারছেন না।

মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হক, সাবেক পরিচালক আনিসুল হক, আসাদুজ্জামান, সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, আব্দুর রহমান, আবুল বসর ভূঁইয়াসহ সাধারণ ও উদ্যোক্তা শেয়ারধারীরা।

যা বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক

ব্যাংকগুলোতে চলমান অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে একটি সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি কিছু কিছু ব্যাংকের দফতরে বা কর্মস্থলে শৃঙ্খলা পরিপন্থি কতিপয় কার্যকলাপ সংঘটিত হচ্ছে মর্মে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোচরীভূত হয়েছে। এ ধরনের কার্যকলাপ ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম ও লেনদেনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। ফলে ব্যাংকের ওপর আমানতকারীদের আস্থার সংকট দেখা দিতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক আরও বলেছে, ব্যাংকের ভেতর শৃঙ্খলা পরিপন্থি কার্যকলাপ ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৫৭(২) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এমতাবস্থায়, ব্যাংকের দফতরে বা কর্মস্থলে আমানতকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ন হয়, এমন কোনও কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার জন্য সবার সহযোগিতা কামনা করা হলো।

 

এই ক্যাটাগরির আরও খবর

ফেসবুকে আমরা